somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়া!

০৭ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৩:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মায়া এক অনির্বচনীয় অনুভূতির নাম। অনির্বচনীয়, তবে ইন্দ্রিয়াতীত নয়, অনুভবযোগ্য। মুনী-ঋষিগণ যতই বলে যাক না কেন "কা তব কান্তা, কস্তে পুত্রঃ" (কে তোমার স্ত্রী, কেই বা তোমার সন্তান?), তবুও তো আমাদেরকে মায়াডোরে বাঁধা পড়তেই হয়। আর জগত সংসারের এই মায়াকে অস্বীকার করিই বা কিভাবে? মায়া আমাকে ভীষণ টানে! আমাকে মায়া করে, ছোটবেলায় বাসায় এমন কোন মেহমান আসলে সহজে তাকে যেতে দিতাম না; আবার কোথাও গিয়ে মায়ার বাঁধনে আটকা পড়লে সহজে ফিরে আসতে চাইতাম না। কৈশোরে সেই ১২ বছর বয়সেই যখন পারিবারিক বন্ধন ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে চলে গেলাম, সেদিন বাসার সকলের জন্য মায়ায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, বিশেষ করে ছোট তিন ভাইবোনের জন্য, কিন্তু কাউকে মুখে কিছুই বলতে পারিনি। তিনমাস পর পর যখন টার্ম-এণ্ড ছুটিতে বাসায় ফিরে আসতাম, তখন প্রথম প্রথম কয়েকদিন আদর যত্নে থাকতাম। তারপর থেকেই পুনরায় শুরু হতো পারিবারিক কড়া শাসনের দৈনন্দিন জীবন। ভাইবোনদের সাথেও ঝগড়া-ঝাটি, খুনসুটি শুরু হতো। তখন মনে হতো, আমি বাসা ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যাওয়াতে এরা বোধহয় মোটেই আমাকে মিস করেনি। ছুটি শেষে কলেজে ফিরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকলে আবার আমার প্রতি খাতির যত্ন একটু একটু করে বাড়তে থাকতো। শেষের দিনে আবার সেই অনুভূতি! কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ, দু’চোখ ঝাপসা, চোখের পাতার দ্রুত ওঠা নামা। এর নাম বুঝি মায়া।

আমার নাতনি আনায়ার বয়স মাত্র ৮ বছর, আর নাতি আরহামের আড়াই বছর। সেদিন ভিডিওতে দেখলাম, ‘কানাডা ডে’ উদযাপন উপলক্ষে ওদের মা বাবা ওদেরকে ফায়ার ওয়ার্ক্স দেখাতে নিয়ে গেছে। আনায়া খুব সুন্দর করে আরহামকে আগলে রাখছে, ও যেন কোন কিছুতে ভয় না পায়। যখন আতশ বাজিগুলো ফুটছিল আর সবাই ওয়াও, ওয়াও করছিল, আরহামও তা দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো, “ওয়াও, আলো ভেঙে গেল”! একটি শিশুর এমন তাৎক্ষণিক একটি কাব্যিক মন্তব্য ধারণকৃত ভিডিওচিত্রে শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম! আরহামের চেয়ে আনায়া মাত্র পাঁচ বছর চার মাসের বড়। কিন্তু বয়সের এই ব্যবধানটুকু অনেক, অনেক বেড়ে যায় যখন আরহাম কোন কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, কারো দ্বারা শাসিত হয়, কিংবা কোন কিছুতে ভয় পায়। সারাদিনে ওরা দুই ভাইবোন যতই ঝগড়া-ঝাটি, খুনসুটি এমন কি মারামারি পর্যন্ত করুক না কেন, উল্লেখিত তিনটি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আনায়া সাথে সাথে মাতৃস্নেহ নিয়ে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে, কম্ফোর্ট দেয়ার চেষ্টা করে, সাহস দেয় এবং তার প্রতি রূঢ় আচরণকারীকে পাল্টা শাসন করে। ঢাকায় আমাদের বাসায় থাকা কালে একদিন আরহাম দুষ্টুমি করার সময় আমি তার সাথে একটু জোরে কথা বলেছিলাম। সেটা শুনে আনায়া ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “এই দাদা, তুমি জান না, আরহাম কত ছোট! তুমি ওর সাথে এত জোরে কথা বলছো কেন”? এই বলে সে আরহামকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অথচ এর একটু আগেই ওরা দু’জনে কিছু একটা নিয়ে মারামারি করছিল! এর নামও বুঝি মায়া!

মেলবোর্নে আমার মেজ ছেলে ও বৌমার বাসায় আমরা এখন বেশ দীর্ঘ একটা ভ্যাকেশন কাটাচ্ছি। আমরা এখানে থাকতে থাকতেই ওদের ঘরে প্রথম সন্তান এসেছে। এই নিয়ে ওরা যেমন আনন্দে উদ্বেল, তেমনি ওকে নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। আমরাও যতটুকু পারি, সাহায্য করছি নবজাতকের সেবা যত্নে। দেখতে দেখতে এই দীর্ঘ অবকাশও প্রায় শেষ হয়ে এলো, শীঘ্রই দেশে ফিরে যাবার দিন চলে আসছে। দিনটা যতই ঘনিয়ে আসছে, অনুভব করছি ছেলে ও বৌমা আমাদের প্রতি ততই বেশি করে অনেক মায়া করছে। এখানে আসার পর পরই ছেলে আমাদেরকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়ে বলেছে, তোমরা অস্ট্রেলিয়ায় এর আগেও এসেছো। গুগল সার্চ করে দেখ, যেখানে যেখানে যেতে ইচ্ছে করে, এই কার্ড ব্যবহার করে সেখানে চলে যাও। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক কিভাবে সার্চ করবো, সে পদ্ধিতিটাও শিখিয়ে দিল। যেমন আমরা ওদের ছোটবেলায় অনেক কিছু শেখাতাম। আমরাও যথেচ্ছা ঘুরে বেড়িয়েছি। বেড়িয়ে আসার পর রাতে যখন খাবার টেবিলে একত্রিত হই, তখন ওরা দু’জনে জানতে চায় কোথায় কোথায় গেলাম, কিভাবে গেলাম, এনজয় করলাম কিনা, ইত্যাদি। প্রথম কয়েকদিন কিছুটা গোলমাল হলেও, তারপর থেকে সফলভাবে ঘুরে ফিরে বাসায় ফিরে আসতে পারছি দেখে ওরা খুশি হয়। এর মধ্যে আমরা এমন কয়েকটা জায়গাতেও ঘুরেছি, যেখানে ওরা এখনও যায় নাই। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, ওরা আমাদেরকে এতদিনের চেয়ে আরও কিছুটা বেশি করে সময় দিচ্ছে। বুঝতে পারছি, আমাদের ফিরে যাবার দিনটি যতই অগ্রসরমান হচ্ছে, ওরাও তত মায়ার ভারে ভারাক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের খাওয়া দাওয়ার প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রাখছে, কথা বার্তাও এমনভাবে বলছে, যা শুনে মনটা নরম হয়ে যায়। এসব দেখে ও অনুভব করে আমার আবার ছুটি শেষে ক্যাডেট কলেজে ফিরে যাবার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। এর নামই বুঝি মায়া!

কাকতালীয় হলেও, এ লেখাটা শেষ করে নীচে যখন তারিখ লিখছিলাম, তখনই মনে পড়ে গেল আজ থেকে ৫৫ বছর আগে, আষাঢ়স্য ঠিক এই দিনেই মুষলধারা বৃষ্টির মাঝে আমি মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছিলাম। বাসা থেকে বিদায় নেয়া পর্যন্ত আম্মা কোন রকমে নিজেকে সামলে রেখেছিলেন। পরে আপির কাছে শুনেছিলাম, আমি চলে যাবার পর পরই আম্মার চোখ দিয়েও আষঢ়ের ঢল নেমেছিল। এখন বলতে লজ্জা নেই, কলেজের প্রথম রাতটি বিনিদ্র কেটেছিল এবং মধ্যরাতের পর আমার চোখ দিয়েও....

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
০৭ জুলাই ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৭৪৪
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৩:৩৮
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×